বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট চলতে পারে শীত না আসা পর্যন্ত

বাংলাদেশ সরকার এখন মনে করছে, দেশটিতে জ্বালানি সংকটের তীব্রতা কাটিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শীতকাল পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।

এরই মধ্যে ডিজেল এবং গ্যাসের ঘাটতির কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন কমানো, লোডশেডিং সহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।

সরকার আশা করছে, সেপ্টেম্বরের শেষে বিদ্যুতের চাহিদা কমে যাবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

এই সংকটের জন্য বিশ্ববাজারে তেল এবং তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস বা এলএনজির চড়া দামকে দায়ী করছে সরকার।

বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের সংকট উদ্বেগজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং এই সংকট আরও বাড়বে।

সংকটের মুখে সরকার এখন ডিজেলের ব্যবহার কমানোর ওপর জোর দিচ্ছে। কিন্তু অকটেন-পেট্রোল সহ বিভিন্ন জ্বালানি তেলের তুলনায় ডিজেলের চাহিদা সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে।

বাংলাদেশে বছরে প্রায় ৫০ লাখ টন ডিজেল আমদানি করতে হয়, যা অন্যান্য তেলের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি।

অন্যান্য খবর:

প্রেসিডেন্ট পুতিনের ইরান সফরের উদ্দেশ্য কী?

তাপদাহে পুড়ছে ব্রিটেন, তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে নতুন রেকর্ড

মৃত্যুর দশ বছর পর কতটা পূরণ হয়েছে লেখক হুমায়ুন আহমেদের শূন্যতা?

কৃষকরা শঙ্কায়

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বাড়লেও জ্বালানি তেলের অভাবে এখন উৎপাদন কমিয়ে দিতে হচ্ছে
বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা অনেক বাড়লেও জ্বালানি তেলের অভাবে এখন উৎপাদন কমিয়ে দিতে হচ্ছে

আমদানি করা ডিজেলের বড় অংশ পরিবহন খাত এবং কৃষিকাজে সেচের কাজে ব্যবহার হয়ে থাকে। ডিজেলের সরবরাহ নিয়ে এই দুই খাতে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

দেশে এখন আমন ধান চাষের সময়। এখনই আমনের জমিতে সেচের জন্য ডিজেল প্রয়োজন উত্তরের জেলা বগুড়ার শিবগঞ্জের একজন কৃষক নাজমুল হকের।

তিনি বলেছেন, ডিজেলের সরবরাহ না থাকলে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কৃষিখাত।

“আমন চাষ করছি। কিন্তু শ্রাবণ মাসেও বৃষ্টি নাই। আমাদের জমিতে সেচের জন্য ডিজেল পাওয়া না গেলে ফসলের ক্ষতি হবে।”

বাংলাদেশের এই পরিস্থিতির জন্য দেশে ডলারের সংকটকে বড় কারণ বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা মনে করেন, দেশের আমদানি ব্যয়ের বড় অংশই হয় জ্বালানি তেল ও গ্যাসের জন্য। ফলে ডলার সঙ্কট সামলাতে সরকারকে জ্বালানির আমদানি ব্যয় কমাতে হচ্ছে।

এছাড়া বিশ্ববাজারে চড়া দামের কারণে জ্বালানি তেলে সরকারকে ভর্তুকি অনেক বেড়ে যাচ্ছে। সরকার ভর্তুকি কোনভাবেই বাড়াতে রাজি নয়। সেজন্য ডিজেল ব্যবহারে রেশনিং করা হচ্ছে।

জ্বালানি খাত নিয়ে কাজ করেন এমন একজন সাংবাদিক অরুণ কর্মকার বলেছেন, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে জ্বালানি সংকট এখন গভীর হয়েছে এবং দ্রুত এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়।

মি: কর্মকার জ্বালানি সংকট নিয়ে তার পর্যবেক্ষণ থেকে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন।

“ডিজেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রতি ইউনিট খরচ পড়ে ৪০ টাকা। এই বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয় সাত বা আট টাকায়। এত বিরাট ফারাক সরকারের পক্ষে পূরণ করা সম্ভব না।

পেট্রোল এবং ডিজেল আমদানি করা যাচ্ছে না ডলারের সংকট দেখা দেয়ায়
পেট্রোল এবং ডিজেল আমদানি করা যাচ্ছে না ডলারের সংকট দেখা দেয়ায়

“দ্বিতীয়ত বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং এর পাশাপাশি দেশে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকারকে ডিজেলের রেশনিং করতে হচ্ছে। ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রায় ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়েছে” বলেন সাংবাদিক অরুণ কর্মকার।

তিনি আরও জানান, দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে ২৩০০ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী চুক্তির ভিত্তিতে কাতার থেকে ৫০০ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে।

ফলে চাহিদার বিপরীতে ৭০০ ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকছে।

এই চাহিদা মেটানো হতো আন্তর্জাতিক খোলাবাজার থেকে আমদানি করে। এখন বিশ্ববাজার চড়া হওয়ায় খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে দুই মাস ধরে।

পরিস্থিতি সামলাতে সারাদেশে সপ্তাহে একদিন ডিজেলসহ জ্বালানি তেলের পাম্পগুলো বন্ধ রাখার সিদ্ধান্তও নিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে অফিসের সময়সূচীও কমানো হচ্ছে।

বাংলাদেশে কৃষিতে সেচের যন্ত্রে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। কৃষকরা চিন্তিত এবার ডিজেল পাওয়া যাবে কিনা।
বাংলাদেশে কৃষিতে সেচের যন্ত্রে জ্বালানি হিসেবে ডিজেল ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। কৃষকরা চিন্তিত এবার ডিজেল পাওয়া যাবে কিনা।

চাহিদা কমার অপেক্ষায় সরকার

সরকার মনে করছে, সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে গরম কমে যাবে এবং তখন বিদ্যুতের চাহিদা কমে আসবে।

তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম তামিম বলেন, জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় দেশের গ্যাস উৎপাদনে নজর দেয়া প্রয়োজন। কিন্তু সে ব্যাপারে সরকারের এখনও তেমন উদ্যোগ নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।

“জ্বালানী আমদানি সাথে সমান্তরালভাবে দেশের ভেতরে সরবরাহ বাড়াতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। দেশে গ্যাস অনুসন্ধান এবং উৎপাদন বাড়ানোর ব্যাপারে কোন চেষ্টা ছিল না,” বলেন এম তামিম।

তেলের দাম বিশ্ববাজারে কিছুটা কমলেও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলছেন, তেলের বিশ্ববাজার এখনও যা রয়েছে, তাতেও ভর্তুকি বেশি দিতে হবে। সরকার তা দিতে রাজি নয়।

নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগও তিনি উড়িয়ে দেন।

“আমাদের গ্যাস অনুসন্ধান এবং খননের কাজ প্রতিদিন চলছে। খনন করলেই গ্যাস পাওয়া যাবে না। আমরা যতটুকু পাচ্ছি, সেই গ্যাস ব্যবহার হচ্ছে” বলেন প্রতিমন্ত্রী।

জ্বালানি সংকটের কারণে এখন বাংলাদেশে ব্যাপক লোডশেডিং শুরু হয়েছে
জ্বালানি সংকটের কারণে এখন বাংলাদেশে ব্যাপক লোডশেডিং শুরু হয়েছে

তিনি আরও বলেন, “আমি আগেও বলেছি, ১০ বছরের মধ্যে আমাদের গ্যাস শেষ হয়ে যাবে। আর বড় কোন গ্যাস ক্ষেত্র পাওয়ার আশা নাই। কিন্তু অনুসন্ধান এবং খননে অনেক খরচ।”

“ফলে খনন করা কতটা লাভজনক-তা দেখতে হবে। সরকারতো এত বোকা নয় যে নিজের গ্যাস ফেলে রেখে বিশ্ববাজার থেকে চড়া দামে গ্যাস আনবে” মন্তব্য করেন নসরুল হামিদ।

আরও পড়ুন:

বিদ্যুৎ আর জ্বালানি সাশ্রয়ে বড় পদক্ষেপের ঘোষণা বাংলাদেশে

বিদ্যুৎ খাতের সাফল্য কি সরকারের জন্য ‘বোঝা’ হয়ে উঠেছে?

বাংলাদেশে গ্যাস সঙ্কট বাড়ছে, শুরু হয়েছে লোডশেডিং

প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে এটা পরিষ্কার যে, জ্বালানির বিশ্ববাজার কবে স্থির হবে, সরকার সেই অপেক্ষায় সরকার রয়েছে।

এদিকে দুই মাস ধরে খোলাবাজার থেকে এলএনজি আমদানি বন্ধ রাখা হয়েছে।

ডলার সংকট এবং চড়া দামের কারণে ডিজেলসহ তেল আমদানিতেও প্রভাব পড়েছে।

কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, এখন দেশে ডিজেলসহ জ্বালানি তেল এবং গ্যাস যা মজুদ আছে, তাতে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত সামলানো যাবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *