ইসলামের সংস্কৃতিক পরিচয় রক্ষা করা আপনার দায়িত্ব
জিয়া উল হক
ইসলাম তার জন্ম থেকেই বৈশ্বিক ধর্ম। কোন বিশেষ অঞ্চল, ব্যক্তি, গোত্র, গোষ্ঠীর ধর্ম নয়। বিশ্বের তাবৎ মানুষের জন্য, সকল স্থানের জন্য। ইসলামের জন্মলগ্ন থেকেই এ এক বাস্তবতার প্রমাণ পাই প্রিয় রাসুল সা: এর তেইশ বসরের নবুওয়তি জীবনের সঙ্গী সাথীদের দিকে দেখলেই। তাঁর জীবদ্দশাতেই, প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এর সাথে যুক্ত হয়েছিলেন, এশিয়া, আফ্রিকা আর ইউরোপ, তিন মহাদেশ থেকে মোট আঠাশজন সম্মানিত সাহাবি। এঁদের মধ্যে সাতাশজনই তাঁর সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। তাঁর স্বাক্ষাৎ থেকে বঞ্চিত ছিলেন আবিসিনিয়ার রাজা নাজ্জাশি।
এই আঠাশজনের মধ্যে আফ্রিকা মহাদেশের (ইরিত্রিয়া, ইথিওপিয়া, মিশর, কমোরোস দ্বীপপুঞ্জ) ছিলেন পনোরো জন। এদেও মধ্যে খৃষ্টধর্ম ও প্যাগন ধর্মের লোকজনও। একজন ছিলেন আফগানিস্থান থেকে (হযরত মুহাব্বিহ ইবনে কামিল রা:)। একজন পাকিস্থানের বেলুচিস্থান থেকে (হযরত কায়েস আব্দুর রাশিদ রা:, ইমরুল কায়েস খাঁন নামেও পরিচিত)। দু’জন ভারত থেকে (কেরালা থেকে হযরত চেরামান পেরুমল তাজউদ্দীন রা: এবং সম্ভবত গুজরাট বা মহারাষ্ট্র থেকে হযরত বাবা রতন হিন্দি রা:)। এই চারজনই ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃতিতে জন্ম নিয়ে বেড়ে ওঠা মানুষ।
অর্থাৎ দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে চারজন (একজন আফগানী, একজন বেলুচি, একজন মালয়ী এবং একজন হিন্দি (সম্ভবত মহারাষ্ট্র বা গুজরাটের, আল্লাহ ভালো জানেন)) সাহাবি হবার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। পারস্যের ছিলেন তিনজন। তৎকালিন রোমান বাইজান্টাইন থেকে দুই জন। কুর্দিস্থান (সম্ভবত মসুল থেকে) এসেছিলেন তিনজন। মিশর থেকে দুই সহোদরা বোন। মোজাম্বিকের পূর্বে সাগরের মাঝে ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র কমোরোস থেকে দু’জনের সৌভাগ্য হয়েছিল প্রিয় রাসুল সা; এর সম্মানিত সাহাবি হবার। তিনজন ছিলেন অনারব ইহুদি। তার মধ্যে দু’জনতো আমাদের সম্মানীয়া উম্মাহাতুল মু’মিনিন; হযরত সাফিয়্যাহ রা: এবং হযরত রাইহানা রা:। এঁদের মধ্যে এগারোজন ছিলেন কৃষœাঙ্গ। নয়জন নারী। আবার এই নয়জনের সাতজনই ছিলেন আফ্রিকা মহাদেশের।
লক্ষণীয়, প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এঁর আন্দোলনের একেবারে শুরুতেই সেখানে জুটেছিলেন বিভিন্ন বর্ণ, ধর্ম ও সংস্কৃতির নারী পুরুষ। জুটেছিলেন ইহুদি, খৃষ্টান, হিন্দু ও মুর্তিপূজক, ছিলেন অগ্নিপূজক এবং প্রকৃতিপূজকও। প্রিয় রাসুল সা: যেমন নানা সংস্কৃতির মধ্যে বাস করেও, ভিন্নধর্মের মানুষদের সাথে সহাবস্থানের নামে কোন সংস্কৃতিকেই ধারণ ও লালন করেননি, ঠিক তেমনই, এই সব সম্মাানিত সাহাবিগণও নিজেদের পুরোনো সাংস্কৃতির দিকে আর কখনোই ঝুঁকেননি। অর্থাৎ তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের নতুন সাংস্কৃতিকে অনড় থেকেছে, আঁকড়ে রেখেছেন।
এইসব মহাসৌভাগ্যবান ও মহাসম্মানিত নরনারীদের প্রত্যেকে নিজ নিজ সমাজে জীবনের উল্লেখযোগ্য অংশ কাটিয়ে এসেছিলেন যেখানে তাদের আত্মীয় স্বজন, বন্ধু বান্ধব’সহ নানা বৈষয়িক টান ও স্বার্থ বিদ্যমান ছিল। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ সমাজের বোধ বিশ্বাস,আদর্শ ও সংস্কৃতিকে ধারন জানতেন। তাদের আগমণে ইসলামের সূচনালগ্নেই গুটিকতক নওমুসলিমদের জামাতে এতোসব সংস্কৃতির উপস্থিতিতে মিশ্র সংস্কৃতির সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা ছিল, তার কিছুই হয়নি।
বরং এইসব সম্মানিত ব্যক্তিবর্গই নিজেদের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে ইসলামি সংস্কৃতিকে ধারন ও লালন করেছেন আজীবন, আমৃত্যু। কেবল তাই নয়, তারা নিজ নিজ জনপদে একেশ্বরবাদী ইসলামি সাংস্কৃতি ছড়িয়েছেন, প্রচার ও প্রতিষ্ঠাও করেছেন। তাঁদের প্রত্যেকেকে নিজ পরিবার ও সমাজের সাথে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বাধা-বিপত্তি এবং নানারকম স্বার্থহানীর মুখোমুখি হতে হয়েছে। তবুও তাঁদেরকে ইসলামি সংস্কৃতিকে আঁকাড়ে রাখা হতে বিরত রাখতে পারেনি। কেউই সাংস্কৃতিক সহাবস্থানের নামে আপোষ করেননি। বরং পৌত্তলিকতাবাদী কিংবা অমুসলিম সমাজেও সামাজিক সহাবস্থান করে গেছেন নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা বজায় রেখেই! এর একমাত্র কারণ হলো এই যে, পৃথিবীর যে যাই বলুক না কেন, বাস্তবতা হলো, সাংস্কৃতির তার সকল রসম রেওয়াজের উৎস হলো ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর মনের কোণে লালিত বোধ বিশ্বাস; ঈমান। মনের মধ্যে পোষিত ঈমান দেখা যায় ব্যক্তির আচারে আচরণে, বক্তৃতা বিবৃতিতে, পোশাকে পরিচ্ছদে, উঠা-বসা, খানাপিনা, তার সাহিত্যে, তার বা তাদের উৎসবে পার্বণে।
ঈমানের দৃশ্যমান প্রকাশই হলো সাংস্কৃতি। মনের কোণে পোষিত ঈমানে যেহেতু তাদের কোন খাদ ছিল না, তাই তারা সাংস্কৃতির ক্ষেত্রেও কোনরকম ব্যতয় রাখেন নি। সহাবস্থানের নামে নিজেদের সাংস্কৃতিকে কলুষিত করেন নি, করতেও দেননি। ইসলামি সাংস্কৃতির অন্যতম মৌলিক বৈশিষ্ঠ যে, সে ভেতরে বাহিরে এক ও অভিন্ন। কোনরকম দ্বৈত রুপ নেই। সে সুযোগও নেই। লক্ষ্য করলে আমরা দেখবেন, পৃথিবীর আর কোন ধর্মই তাদের সাংস্কৃতিতে এ বৈশিষ্ঠকে ধারন করে না। ইসলামই এক্ষেত্রে এককভাবে ব্যতিক্রম ও অনন্য। এ জন্যই ইসলাম পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবনাদর্শ।
সেই অনন্য সাৃংস্কৃতির ধারক আজকের মুসলমানরা যখন সহাবস্থান, প্রগতিবাদিতা কিংবা আধুনিকতার নামে ইসলামি সাংস্কৃতিকে কলুষিত করে, নিজেদের সাংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে ভিন্ন সাংস্কৃতির অনূবর্তি হয় কিংবা ভিন্ন সাংস্কৃতির দাসত্বে মাতে, পাশাপাশি আবার প্রিয় রাসুল সা: এর উম্মত হবার দাবীও করে, তখন কেবল হাসিই পায় না, লজ্জাও পেতে হয় বটে! অবশ্য এই লজ্জাবোধটুকু কেবল তাদের মনেই জাগতে পারে, যাদের বোধে ও বিশ্বাসে, চিন্তা ও চেতনায় আত্মমর্যাদা বোধ, আত্মপরিচয়ের ছিটেফোটার কিছুটা হলেও টিকে আছে। ইতিহাসের এই পাঠটুকু স্মরণে নিয়ে প্রত্যেকের উচিৎ নিজের মনের কোণে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখা, সেখানে কোন আত্মমর্যাদাবোধ কিংবা আত্মপরিচয়ের লেশমাত্র বাঁকি আছে কি না। খুব বেশি দেরি হবার আগেই আমাদের প্রত্যেকের জীবনের মিশন হওয়া উচিৎ আত্মপরিচয়ের সন্ধান।
আজকের যুব প্রজন্মকে অত্যন্ত সচেতনা ও পূর্ণ দায়িত্ববোধের সাথে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ইসলামি সাংস্কৃতির এই অনন্য বৈশিষ্ঠকে কেবল ধারনই করতে হবে না, বরং সেটাকে জীবন ও সমাজের প্রতিটি স্তরে সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠাও করতে হবে।
লেখক: বহুগ্রন্থ প্রণেতা ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী