শুভ নববর্ষ
জিয়া উল হক
ভাষা, আল্লাহর এক অনূপম ও বিষ্ময়কর সৃষ্টি। ভাষার অস্তিত্ত না থাকলে মনুষ্যপ্রজাতি এবং এ বিশ্বের অস্তিÍত্ত থাকতো না। মানুষের অন্যতম সম্পদ, হলো তার ভাষা। অন্যান্য সৃষ্টির মতো ভাষার বৈচিত্রতাও উদ্দেশ্যমূলকভাবেই সৃষ্ট। এবং তা জ্ঞানীদেও জন্য সম্পদ ও নিদর্শন ( সুরা রূম : ২২) বিভিন্ন প্রাসঙ্গিক বিষয় বুঝাতে ‘ভাষা’ ও তার ‘সমার্থক শব্দ’ (লিসান/ বয়ান) কুরআনের ১৫টি সুরার সতেরোটি আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। আপনি এই সতোরোটি আয়াতকে তার পূর্বাপর ঘটনাপ্রবাহকে সামনে রেখে বিচার বিশ্লেষণ করলে ভাষার মর্যাদা ও গুরুত্ব নিয়ে একভিন্ন দিগন্ত উন্মোচিত হয়ে চিন্তার জগতে ভিন্ন খোরাক দেবে। আমাদের সকল বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকান্ড, ভাবনা ও তার প্রকাশ ভাষার মাধ্যমেই হয়ে থাকে। ( সুরা আর-রহমান : ৩-৪ )
তার মানে ভাষা জানাটাই কেবল গুরুত্বপূর্ণ নয়, তার যথাযথ ব্যবহার করতে পারাটাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভাষার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে মনের ভাবকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারাটাও এক অতি গুরত্বপূর্ণ জ্ঞান। এটাও আল্লাহই মানুষকে শিখিয়েছেন সৃষ্টির একেবারে শুরুতেই। হযরত আদম আ: কে দিয়ে এ ধারার শুরু (সুরা বাকারা : ৩১)। ভাষার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করার শক্তি ও কৌশলটা আদম আ: পুরোপুরি রপ্ত করে তার যথার্থ উপস্থাপনও করেছিলেন। এধারা সেই থেকে চলমান। মানুষ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার করে আসছে সেই থেকে এবং কেয়ামত পর্যন্তও তা চালু থাকবে। আদম আ: এর জ্ঞান ও ভাষায় চৌকষ দক্ষতায় ফেরেশতারা বিষ্মিত, বিমোহিত ও মুগ্ধ হয়ে সিজদাহতে পড়ে গেলেন। আর ইবলিশ দম্ভ ও হিংসাবশত সিজদাহ হতে বিরত থেকে নিজের ধ্বংস ও অভিশাপ ডেকে নিল।
মানুষ কথা বলে। তবে সবাই একই ধাঁচের কথা বলতে পারেন না। একই ভাষাভাষীদের মধ্যেও সবাই একই মানে ভাষার ব্যবহার পারেন না। আল্লাহর নবী আ: গণকে ভাষার ব্যবহারে অতি উচ্চ, এমনকি, সর্বোচ্চ স্তরের দক্ষতা দিয়েছিলেন, যেন শ্রোতাদের মনে তাঁদের বক্তব্যে প্রভাব পড়ে। প্রিয় রাসুলুল্লাহ সা: এঁর এই যোগ্যতা ছিল বিষ্ময়কর পর্যায়ের। ভাষার ব্যবহাওের তিনি অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। সেই প্রিয় রাসুল সা: এঁর উম্মত হিসেবে ভাষা জানা ও তার ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করাটা প্রত্যেক মুসলমান যুবকের দায়িত্ব। যুবপ্রজন্মকে ভাষার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করতেই হবে। মাতৃভাষা তো বটেই, এমনকি, বিদেশি ভাষাও শিখতে হবে জ্ঞানার্জন ও সমাজবাসীকে সত্য ও সুন্দরের বাণী পৌছে দিতে। এ উদ্দেশ্যটা কুরআন থেকেই জানা যায় ( সুরা আহক্বাফ : ১২ )।
কাজেই ভাষার ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জন করার কোন বিকল্প নেই মুসলমান যুবসমাজের জন্য। বর্তমান বিশ্বে কয়েক হাজার (প্রায় সাড়ে ছয় হাজার) ভাষার অস্তিÍত্ত রয়েছে। কোনটা সবচেয়ে বড়ো ভাষা, তথা, কোন ভাষায় সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে? সে প্রশ্নটা আসতে পারে। কোনো কোনো দেশে একাধিক ভাষাকে ( প্রধান ভাষা ও দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে) ব্যবহার হয়। যেমন কানাডা, সেখানে একইসাথে ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা চলছে। আফ্রিকা ও উত্তর আফ্রিকার অনেক দেশেই নিজ নিজ ভাষার পাশাপাশি ফরাসি ভাষা চালু রয়েছে। আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলেও পাশাপাশি ইংরেজিও চালু রয়েছে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে।
সংখ্যাবিচারে সবচেয়ে বেশি মানুষ কথা বলে থাকেন; মান্ডারিন চাইনিজ ভাষায়; একানব্বই কোটি, স্প্যানিশ ভাষায় আচল্লিশ কোটি, ইংরেজি ভাষায় আটত্রিশ কোটি, হিন্দি ভাষায় চৌত্রিশ কোটি, পর্তূগিজ ভাষাতে চৌত্রিশ কোটি, ফরাসি ভাষায় আঠাশ কোটি, বাংলা ভাষায় সাড়ে ছাব্বিশ কোটি এবং রাশিয়ান ভাষায় পনেরো কোটি। বর্তমানে জ্ঞানার্জনের জন্য আমাদের মাতৃভাষা ছাড়া আর কোন ভাষা বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিৎ? জ্ঞান, বিজ্ঞান ও গবেষণার ভৌগলিক অবস্থান কোথায়, সেটা বিচার করলে আমরা বুঝতে পারবো জ্ঞানার্জনের জন্য আপাতত কোন ভাষাগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে, সেটা।
বিগত ২০২০ খৃষ্টাব্দে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশত ইউনিভার্সিটির মধ্যে আটলান্টিকের ওপারে অবস্থিত ৪৪টি (আমেরিকা ৪০ ও কানাডা ৪), ইউরোপে ৩৭টি, অস্ট্রেলিয়ায় ৬টি। ইংরেজিভাষী দেশসমূহে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ একশতটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্ততপক্ষে ৬১ টি বিশ্বদ্যিালয় রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা আর অস্ট্রেলিয়া মিলে রয়েছে ঐ একশতটির মধ্যে ৮৭টি বিশ্ববিদ্যালয়। এ তথ্য আপনাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেবে যে, কোন ভাষার প্রতি আপনার প্রাধান্য দেয়া উচিৎ।
পৃথিবীর যতো জ্ঞান রয়েছে, যে বিষয়ের জ্ঞানই হোক না কেন বা যে সমাজ ও জনপদেরই হোক না কেন, তা ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। আপনি পছন্দ করেন বা না করেন, ইংরেজি ভাষা জানাটা আপনার সামনে জ্ঞানের ভিন্ন এক দূয়ার খুলে দেবে। পাশপাশি আরবি ভাষা আপনার জন্য হবে জ্ঞানার্জনের পথে দ্বিতীয় বৃহত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ উৎস। ইংরেজি ভাষায় যতো জ্ঞানই পাওয়া যাক না কেন, তার মৌলিক সুত্রসহ পুরোনো জ্ঞানগুলো প্রায় সবই পাওয়া যাবে আরবি ভাষায়। তা ছাড়া, একজন মুসলমান হিসেবে কুরআন ও হাদিস, ইজমা, কিয়াস, ফিক্বহ ছাড়া জীবনটাই বৃথা হতে বাধ্য। তথাকথিত আধুনিকতা ও প্রগতিবাদীতার ছোবল থেকে ঈমান ও মানবিকতা বাঁচাতে ওগুলোই হলো সবচেয়ে বড় কার্যকর অস্ত্র।
এবাওে আপনিই ভাবুন, দ্বিতীয় ও তৃতিয় ভাষা হিসেবে কোন ভাষা শিখবেন। তবে শিখুন। জ্ঞানের জগৎকে ঋদ্ধ ও সমৃদ্ধ করতে বিদেশি ভাষা শিখুন। ইংরেজি ও আরবি ভাষা শেখাটা বাংলাদেশি মুসলমানদের পক্ষে অত্যন্ত সহজ। ভাষাদু’টো শিখে জ্ঞানচর্চা করতে পারলেই আপনি বিশ্বের বুকে আপনার পদচিহ্ন রেখে যেতে পারবেন আগামি দিনের জন্য। আপনার জাতি ও উম্মাহ আপনাকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে। আপনিও এক ধরনের তৃপ্তি নিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারবেন, ইনশাআল্লাহ। অতএব, নববর্ষের শুরুতেই আপনার স্বিদ্ধান্ত হোক, এ বৎসর নতুন একটি ভাষা শেখা শুরু করবেন। শুভ নববর্ষ।
লেখক: বহুগ্রন্থ প্রণেতা ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী