মাছির চোখ ও বই পড়া এবং একুশ শতকে নিশ্চিত সাফল্যের দু’টি কৌশল !
জিয়া উল হক
মাছির চোখ Compound Eye ‘কম্পাউন্ড আই’! উপরে, নিচে, ডানে, বামে, একই সাথে সবদিকে দেখতে পায়। সৃষ্টির এক অপার বিস্ময়! তার প্রায় চার হাজার চোখ! বা তার চোখের চার হাজার স্বতন্ত্র অংশ; Ommatidia রয়েছে । প্রতিটিই একটি করে স্বতন্ত্র চোখ। মানুষের চোখের চেয়ে মাছির চোখ পাঁচগুণ বেশি দ্রুত মুভ করে। বিশ্বের প্রাণীকুলের মধ্যে মাছিই সবচেয়ে দ্রুত তার দৃষ্টিগোচর হওয়া বস্তুর প্রতি সাড়া দেয় (Fastest Visual response)। এ কারণেই মাছিকে ধরা মুশকিল। আপনি তাকে ধরতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আপনার শরীরের প্রতিটি মুভমেন্ট মাছি দেখতে পাচ্ছে, সময়মত সাবধান হচ্ছে, উড়াল দিচ্ছে। তারপরেও মাছিকে ধরা সম্ভব। মাছি পরাস্থ হয় গতির কাছে। আপনি যদি তার গতির চেয়ে বেশি গতিতে হাত চালিয়ে ধরতে চান, তাহলে পারবেন।
কোন একজন পশ্চিমা পন্ডিত খুব মূল্যবান কথা বলেছিলেন বই পড়া নিয়ে। তিনি এক একটি বইকে এক একটি চোখের সাথে তুলনা করে বলেছিলেন; আপনি যদি একটা বই পড়েন তার মানে হলো আপনি নতুন একটা চোখ সংযোজন করে নিচ্ছেন নিজের জন্য। আপনার দৃষ্টিভংগী ও দৃষ্টিশক্তি প্রখর হবে, তীক্ষ্ন হবে। আপনি অনেক দূর দেখতে পাবেন, অনেক কিছু দেখতে পাবেন। ‘অনেক কিছু’ আর ‘অনেক দূর’ দুটো আপেক্ষিক বাক্য, অতি গভীর অর্থবোধক বাক্য। এর অর্থ ও ভাব পুরোটা উপলব্ধী করা দরকার।
‘অনেক কিছু’ বলতে, আপনি ঘটমান ঘটনাসমূহ যা আর দশজন দেখছেন, যেভাবে দেখছেন, তা’র চেয়েও বেশি কিছু দেখতে পাবেন, যেভাবে ঘটছে, তার বাইরেও ঐ একই ঘটনার ভিন্ন মাত্রা দেখতে পাবেন। এর রেশ, পরিণতি ও ভবিষ্যৎটাও দেখতে পাবেন। আপনার ইতিহাস জ্ঞান, দর্শনের জ্ঞান, সমাজ নিয়ে চেতনাবোধ আপনাকে প্রতিটি ঘটনার দৃশমান রুপের আড়ালে রয়ে যাওয়া ঘটনা ও তার রেশ বা ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া দেখতে বা উপলব্ধী করতে সাহায্য করবে। সেরকম সক্ষমতা ও শক্তি জোগান দেবে। একইভাবে ‘অনেক দূর’ বলতে ফুট, গজ বা মাইলের দুরত্ব বুঝাচ্ছি না, বরং ভবিষ্যত কাল বা সময়ের দূরত্ব বোঝাচ্ছি। নিকট অতিতের ইতিহাস থেকে একটা উদাহারণ দেই।
একদল ইউরোপীয় ইহুদি ১৯০৭ সালে প্রথমবারের মত জেরুজালেম সফর এবং সেখানে Palestine Land Development Company নামে একটি ব্যবসায়িক কোম্পানী প্রতিষ্ঠ করে। এই কোম্পানীটি ইংল্যন্ড, আমেরিকা, জেনেভা, সুইজারল্যন্ড সহ বিশ্বের অনেক দেশেই ধনাঢ্য ইহুদিদের দেয়া অর্থে বাজার দরের চেয়ে অনেক উচ্চমুল্য দিয়ে প্যালেস্টাইনে গরীব ফিলিস্তিনি আরবদের কাছ থেকে জমি ক্রয় করে সেই সব জমিতে উন্নত পদ্ধতিতে চাষাবাদ করার মাধ্যমে ‘কৃষিপ্রকল্প’ গ্রহণ করে। র্বতমান তেলআবিবের একটি পাহাড় একইভাবে কিনে নিয়ে সেখানেই গড়ে তোলা হয় ‘আধুনিক কৃষিখামার’!
জেরুজালেমের তখনকার গ্রান্ড মুফতি আমিন আল হুসাইনি আমেরিকান, ব্রিটিশ, রাশিয়ান ও ইউরোপিয়ান ইহুদিদের এ ধরনের তৎপরতার পেছনে অশুভ ষড়যন্ত্রটা উপলব্ধী করেন। তিনি তাদের পরিকল্পনা আঁচ করে ফিলিস্তিনিদের কাছে বার বার মিনতি করেন, তারা যেন ইউরোপীয় ইহুদিদের কাছে জমি বিক্রি না করে, যতই চড়া দাম দিক না কেন। সাধারণ ফিলিস্তিনিরা তার এ কথায় কান দেয়নি। দুই তিনগুন বেশি দাম পেয়ে তারা জমি বিক্রি করে দেয় ইহুদিদের কাছে। সেই সব জমিতে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা এসে বসতি স্থাপন করে। এর পরিণতি কি হয়েছে সেটা আজ আর কাউকেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে না। সেদিনকার সেই ‘কৃষিখামার’ই আজ ইসরাইলের রাজধানী; তেলআবিব! মুফতি হুসাইনি তার জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শীতার কারণে সেদিনই ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বুঝতে পেরেছিলেন, আর সেটাই বুঝতে ব্যার্থ হয়েছে আপামর ফিলিস্তিনি আরব জনতা।
এই যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শীতা, এগুলো হলো আপনার সেই চোখ, অন্তরের চোখ; অন্তর্দৃষ্টি, যা মাছির চার হাজার চোখের চেয়েও ক্ষমতাসম্পন্ন ও শক্তিশালী। এই জ্ঞান, প্রজ্ঞা আর দূরদর্শীতা সৃষ্টির একটামাত্র উপায় ; জ্ঞান চর্চা করা। এর জন্য বইু পড়ুন। সিরিয়াস বই, প্রেমের রোমান্টিক বই পড়তে চাইলে তাও পড়তে পারেন। তবে সমাজ ও বিশ্বকে প্রভাবিত করার মত জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শীতা জন্মাতে চাইলে ধর্ম, দর্শন, ইতিহাস, রাজনীতি, সমাজ, আত্মজীবনী এরকম সিরিয়াস বই পড়তে হবে। এর বিকল্প নেই। একটি বই পড়া মানে হলো, আপনার ভেতরে আরও একটি চোখ সংযোজিত হলো; আপনার জ্ঞান বাড়লো, অতিত ইতিহাসকে বিশ্লেষণ করে অনাগত ভবিষ্যৎকে দেখার যোগ্যতাও সৃষ্টি হলো।
কেবল তাই নয়। বেশি বেশি সিরিয়াস বই পড়ার কারণে আপনার ভেতরে যে জ্ঞান সৃষ্টি হচ্ছে, তার উপরে ভিত্তি করেই তৈরি হবে প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা হলো; যথাসময়ে জ্ঞানের যথাযথ ব্যবহারে ব্যক্তির কৌশল ও দক্ষতা। অর্থাৎ ত্বরিৎগতিতে যথাযথ স্বিদ্ধান্ত নিতে পারা। এটা একটা দূর্লভ গুণ। জ্ঞান থাকলেই এই গুনটা ব্যক্তির ভেতরে থাকবে তেমনটা নয়, তবে যথাযথ জ্ঞানের যথাযথ চর্চা ও নিরন্তর ভাবনায় প্রজ্ঞার জন্ম নিতে পারে। জ্ঞানের সাথে সাথে আপনার ভেতরে চিন্তার গতি; প্রতূৎপন্নমতীতা যদি থাকে, তবে আপনি অনেকটাই অজেয়। অতএব বেশি বেশি বই পড়ুন, আপনার অন্তর্দূষ্টিকে প্রখর করুন, দিগন্তজুড়ে প্রসারিত করুন। মাছির জীবন থেকে শিক্ষা নিন।
একুশ শতকে নিশ্চিত সাফল্যের দু‘টি কৌশল !
লেখার উপরে শুরুর দিকে মাছির চোখ নিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী উল্লেখ করেছি। সেখানে বলেছিলাম মাছি Compound Eye ‘কম্পাউন্ড আই’ এর অধিকারী! যুগপৎ উপরে, নিচে, ডানে, বামে, সবদিকে দেখতে পায়। কারণ তার প্রায় চার হাজার চোখ (Ommatidia) রয়েছে। এই চার হাজার চোখের উপস্থিতি ছোট্ট এই প্রাণীটিকে বিষ্ময়কর এক সৃষ্টরি মর্যাদা দিয়েছে। তার আরও একটা বিশেষ বৈশিষ্ঠ রয়েছে, সে ক্ষেত্রে সে বিশ্বের বুকে চ্যাম্পিয়নও বটে। বিশ্বের প্রাণীকুলের মধ্যে মাছিই সবচেয়ে দ্রুত তার দৃষ্টিগোচর হওয়া বস্তুর প্রতি সাড়া দেয় (Fastest Visual response)।
আমাদের, তথা, মানুষের চোখের চেয়ে মাছির চোখ পাঁচগুণ বেশি দ্রুত মুভ করে। এ কারণেই মাছিকে ধরা মুশকিল। আপনি আমি তাকে ধরতে প্রস্তুতি নিচ্ছি, খুব সাবধানে এগুচ্ছি কিন্তু তারপরেও সে আমাদের শরীরের প্রতিটি মুভমেন্ট ঠিকই দেখতে পাচ্ছে। সময়মত সাবধান হয়ে উড়াল দিচ্ছে। তবে তারপরেও মাছিকে ধরা সম্ভব। আমরা চেষ্টা করলেই তাকে ধরে ফেলি। মাছি পরাস্থ হয় গতির কাছে। আমরা যদি তার গতির চেয়ে বেশি গতিতে হাত চালিয়ে ধরতে চাই তাহলে তাকে ধরতে পারি।
অর্থাৎ চার হাজার চোখ ও দৃষ্টিগোচর হওয়া বস্তুর প্রতি সবচেয়ে দ্রুত সাড়া দিতে সক্ষম এরকম একক বৈশিষ্ঠের অধিকারী মাছিও তার সেই বিশ্বসেরা শক্তি থেকে কোনরকম ফায়দা লাভ করতে পারে না, কারণ সে স্বিদ্ধান্ত গ্রহণে দেরি করে ফেলে। তার গতি তাকে ধরতে সচেষ্ট মানুষের গতির চেয়ে দ্রুততর নয়। সময়মত এবং যথাযথ গতিতে সে উড়ল দিতে ব্যর্থ, তাই সে পরাস্থ হয়। আমাদের দৈনন্নিদন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরাও ঠিক এ দুটো কারণেই ব্যর্থতার মুখোমুখি হই। প্রথমটি হলো; সময়কে যথাসময়ে এবং যথাযথভাবে কাজে লাগাতে পারি না, কাজে লাগাই না। আমরা সময় নিয়ে বড় হেলা ফেলা করি। সময়ের ব্যাপারে ক্ষমার অযোগ্য ও সীমাহীন অপচয় করি। যা আর কখনোই পূরণ করা ম্ভব হয়ে উঠে না।
আর দ্বিতীয় যে কারনে আমরা ব্যর্থ হই, তা হলো জ্ঞান অর্জন, আমাদের চারিপাশের সমজা ও পরিবেশকে বুঝতে আমরা খুব দেরি করে ফেলি। আমাদের সমাজ ও তার সাথে সংশ্লিষ্ঠ প্রতিটি বিষয় (স্থানীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতি) যে গতিতে বদলে যাচ্চে, ঠিক সেই গতিতে আমরা নিজেদেরকে প্রস্তুত করি না, ফলে আমরা আমারে সকল সদ্চ্ছিা, জ্ঞান, সকল আন্তরিকতা সত্তেও বার বার পরাস্থ হই। আশে পাশে অনেক যুবকের মধ্যে চমৎকার সব দক্ষতা ও যোগ্যতা দেখতে পাই, কিন্তু এই দু’টো কারনের যে কোন কেটি বা উভয়টির জন্য তারা নিজ নিজ পেশায় যেমন ব্যর্থ, ঠিক তেমনই ব্যর্থ তাদের জীবনেও।
বিশেষ করে তরুণ, যুবকদের বলছি, তোমরা যারা দেশ, সমাজ বদলে দিতে চাও, তারা আগে নিজেদের বদলে দাও। তোমরা পৃথিবীর সাথে তাল বজায় রেখে নিজেদের জ্ঞান ও দক্ষতাকে তৈরি করো, আর সময়টাকে সর্বোচ্চ গুরুত্বের সাথে কাজে লাগাও। প্রচন্ড প্রতিযোগীতাময় একুশ শতকের বিশ্বে এ দুটো নিয়ম মেনে চলো, সাফল্য তোমার পায়ে আছড়ে পড়বে, নিশ্চয়তা দিচ্ছি।
লেখক: বহুগ্রন্থ প্রণেতা এবং যুক্তরাজ্য প্রবাসী। লেখাটি তার ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহিত।