পবিত্র আশুরা : করণীয় ও বর্জনীয়
মীম মিজান
আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিন জ্বীন ও মানবজাতিকে শুধু মাত্র তাঁরই এবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু বিতাড়িত শয়তান নানা প্ররোচণায় মা’বুদের ইবাদত থেকে ফিরিয়ে রবের অসন্তুষ্টির কাজে আমাদেরকে ধাবিত করে। আল্লাহ্ রাহমানুর রাহিম। তাই তাঁর বান্দাদের প্রতি সদয় হোন এবং মহান আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর সেই সব গোনাহ্গার বান্দাসহ প্রিয় বান্দাদের নাজাতের জন্য অনেক উপায় ও উছিলা রেখেছেন। তন্মধ্যে অন্যতম উছিলা হচ্ছে আশুরা। আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশেরা’ শব্দ থেকে রূপান্তরিত। আর ‘আশেরা’ হচ্ছে ‘আশারা’ শব্দের বিশেষণ। যার সাধারণ বাংলা অর্থ হচ্ছে দশ, দশক, দশজন বা দশটি অর্থাৎ ‘আশারা একটি আরবি সংখ্যার নাম- যার বাংলা অর্থ দশ। দেখা যাচ্ছে, আরবি সংখ্যা ‘আশারা’ (১০) থেকে ‘আশেরা’ (দশম)। আর তার থেকে ‘আশুরা’ শব্দটি নির্গত হয়েছে যার অর্থ, মুহররম মাসের ১০ তারিখ। (লিসানুল আরব, ৪/৫৬৯)। এই শাব্দিক পরিবর্তনের ফলে অতিরঞ্জন এবং সম্মানের অর্থ পাওয়া যায়। (ফাত্ হুল্ বারী, ৪/৩১১)। আশুরার দিননির্ণয়ের দিকে যদি আমরা তাকাই তাহলে আমরা পাই, আশুরার দিনটি মুহররম মাসের নবম দিন না দশম দিন? এ বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। তবে অধিকাংশ উলামার মতে মুহররম মাসের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। কারণ শব্দের নামকরণ ও উৎপত্তি, দশ তারিখকেই সমর্থন করে। (ফাতহুল বারী, ৪/৩১১)। তাছাড়া আশুরা বিষ হাদিসগুলি দ্বারা দশ তারিখ বুঝা যায়, ৯ তারিখ নয়।
আমরা জানি যে, পবিত্র রমজান মাসের অনেক গুরুত্ব। তবে সেই গুরুত্বের পিছনে পেয়েছে অনেকগুলো কারণ এ মাহাত্ম। তাই আমরা রমজানকে খুবই গুরুত্বের সাথে পালন করি। আমরা যদি ঠিক অনুরূপ আশুরার গুরুত্ব বা মাহাত্ম যদি খুঁজি তবে আমরা আল হাদিস, ফিকহ্ ও ইসলামের ইতিহাস থেকে জানতে পারি যে, নিম্নোক্ত ঘটনাবলির কারণেই এই আশুরার এত গুরুত্ব। ১. আশুরার দিন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র লাওহে মাহফুজ সৃষ্টি করেছেন। ২. এই দিনে যাবতীয় সৃষ্টির রুহ পয়দা করেছেন। ৩. এই দিনে হজরত আদমকে (আ.) সৃষ্টি করা হয়েছিল। ৪. হজরত আদমের (আ.) তাওবা কবুল করা হয়েছিল। ৫. আদমকে (আ.) জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছিল। ৬. হজরত নুহ (আ.) মহাপ্লাবনের শেষে জুদি পাহাড়ে অবতরণ করেন। ৭. হজরত ইব্রাহিমকে (আ.) সৃষ্টি করা হয়েছিল। ৮. হজরত ইব্রাহিম (আ.) এই দিনে অগ্নিকুন্ড হতে নাজাত পেয়েছিলেন। ৯. হজরত মুসা (আ.) তুর পর্বতে আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ১০. হজরত মুসাকে (আ.) তাওরাত কিতাব নাযিল করা হয়েছিল। ১১. হজরত মুসার (আ.) শত্রু ফিরাউনের নীল নদে ভরাডুবি হয়েছিল আশুরায়। ১২. হজরত আইয়ুব (আ.) এই দিনে রোগ থেকে মুক্তি পান। ১৩. হজরত ইয়াকুব (আ.) তাঁর প্রিয় পুত্রকে ফিরে পান। ১৪. হজরত ইউনুসকে (আ.) মাছের পেট থেকে দজলা নদীতে পড়েছিলেন এই দিন। ১৫. হজরত সুলাইমান (আ.) পুনরায় রাজত্ব ফিরে পান। ১৬. হজরত ঈসা (আ.) পৃথিবীতে আগমন করেন এবং ১৭. হজরত ঈসাকে (আ.) আকাশে তুলে নেওয়া হয় এই দিনে। ১৮. হজরত জিব্রাইল (আ.) সর্বপ্রথম আল্লাহর রহমত নিয়ে রাসুল (সা.) নিকট আগমন করেছিলেন। ১৯. রাসুলের (সা.) প্রিয় নাতি হজরত হোসাইন তাঁর সঙ্গী ও সহচররা কারবালার ময়দানে শহীদ হন। ২০. আশুরার কোন এক শুক্রবার ইস্রাফিলের (আ.) সিঙ্গায় ফুৎকার দেবেন এবং পৃথিবী ধ্বংস হবে। তাই এরকম একটি পবিত্র দিনে আমরা কি করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করব সেই করণীয়সমূহ আমাদের জানা উচিৎ না হলে গুনাহ মাফের এ মোক্ষম সুযোগ হাতছাড়া হতে পারে। সেই করণীয়সমূহ হলো- আশুরার দিন রোযা রাখা। কেননা এদিনের রোযা গত এক বছরের রোযাকারীর গুনাহসমূহের কাফফারা স্বরূপ। হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি আশাবাদী যে, আশুরার রোযার কারণে আল্লাহ তা-আলা অতীতের এক বছরের (সগীরা) গুনাহ ক্ষমা করে দিবেন।’ (সহীহ মুসলিম ১/৩৬৭; জামেতিরমিযী ১/১৫৮)। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে: রাসূলুল্লাহ সা. বলেন, ‘মুহররম মাসের দশ তারিখে কেউ রোযা রাখলে অতীতের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে বলে আমার আশা।’ (মেশকাত শরীফ, পৃষ্ঠা-১৭৯)। এছাড়াও এ দিনটিতে কী করণীয় তা বুখারী ও মুসলিম শরীফে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন- ‘রাসূলুল্লাহ সা. মক্কা থেকে হিজরত করে মদীনায় গিয়ে দেখলেন, মদীনার ইহুদীরা মুহররমের দশ তারিখে আশুরার দিনে রোযা রাখে। রাসূলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন- ‘এ দিনটি কিসের? এ দিনে তোমরা রোযা রাখ কেন?’ তখন ইহুদীরা উত্তর দিল- ‘এটা একটা মহান দিন। এ দিনে আল্লাহ তা’আলা হযরত মুসা (আ.) এবং তাঁর গোত্র বনি ইসরাইলকে সমুদ্র পার করিয়ে দিয়েছিলেন। শত্রুর হাত থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। আর মুসলমানদের দুশমন ফেরাউন ও তার গোত্রকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।’ ‘হযরত মুসা (আ.) এই বিপদ থেকে মুক্তি পেয়ে এই মহান নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার লক্ষ্যে এই দিনে রোযা রেখেছিলেন। এজন্য আমরাও এ দিনে রোযা রাখি।’ তখন নবীয়ে কারিম (সা.) ইরশাদ করলেন- ‘হযরত মুসা (আ.) এর আমল অনুসরণ করার ব্যাপারে তোমাদের চেয়ে আমরা বেশি হকদার, বেশি নিকটতম। সুতরাং হযরত মুসা (আ.) যদি এটা করে থাকেন, তাহলে আমাদেরও করা দরকার।’ তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে এ দিনে রোযা রেখেছেন এবং সাহাবায়ে কেরামকেও রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন। তাহলে বোঝা গেল, এ রোযার ফযিলত এজন্য যে, হযরত মুসা (আ.) এদিন বড় একটি নেয়ামত পেয়েছিলেন। আল্লাহ তা’আলা তাকে ও তাঁর কওম বনি ইসরাইলকে সমুদ্রের বিপদ থেকে রক্ষা করেছিলেন। আর ফেরাউন ও তার কওমকে সমুদ্রে ডুবিয়ে মেরেছিলেন। আল্লাহ তা’আলা এত বড় বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন, এর শুকর আদায়ের জন্য হযরত মুসা (আ.) রোযা রেখেছিলেন।
আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য নফল ইবাদাত বন্দেগি করাও এ দিনের করণীয়। অনেককে এই দিনে রোযা রাখার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতে শুনা যায়: এই দিনে হুসাইন (রা:) শহীদ হয়েছিলেন তাই আমরা রোযা আছি। দ্বীনের বিষয়ে এটি একটি বিরাট অজ্ঞতা। সাধারণ লোকদের এই উত্তরের পিছনে আছে শিয়া সম্প্রদায়ের কৃতিত্ব। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর পৌত্র হুসাইন (রা:) এই দিনে ইরাকের কারবালা মাঠে মর্মান্তিক ভাবে শহীদ হয়েছিলেন। তাই শিয়ারা এই দিনটিকে শোক দিবস হিসাবে বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে উদযাপন করে থাকে। এমনকি এই দিনে সরকারি ছুটিও থাকে। তাই সাধারণ লোকদের নিকট এই দিনটির পরিচয় এবং মর্যাদার কারণ হচ্ছে, হুসাইন (রা:) এর শাহাদত। আর এ কারণেই হয়ত: তারা বলে থাকে যে, হুসাইন (রা:) শহীদ হয়েছিলেন তাই রোযা করছি। তাই এটি একটি বিরাট ভুল ধারণা। কারণ যেই দিন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারা গেছেন সেই দিন থেকে সমস্ত অহী (প্রত্যাদেশ) বন্ধ হয়ে গেছে যার মাধ্যমে ইসলামের আদেশ-নিষেধ আসতো। ইসলাম পূর্ণতা লাভ করার পরেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তাই তাঁর মৃত্যুর পর ইসলামের নামে কোন বিধান আবিষ্কৃত হবে না। কেউ এমন করলে তা বিদয়াত (দ্বীনের নামে নতুন বিধান) হবে, যা প্রত্যাখ্যাত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “যে ব্যক্তি আমাদের এই দ্বীনে নতুন কিছু আবিষ্কার করলো যা, এর অংশ নয় তা প্রত্যাখ্যাত।” (বুখারী, মুসলিম) তাই যারা এই নিয়তে রোযা করে থাকে যে, এই দিনে হুসাইন (রা:) শহীদ হয়েছিলেন, তাহলে তাদের রোযা তো হবেই না বরং তাদের এই আমল বিদয়াতে পরিণত হবে। আর অনেক ক্ষেত্রে শিরকও হতে পারে যদি কেউ হুসাইন (রা:) এর উদ্দেশে তা পালন করে থাকে। কারণ আল্লাহ ব্যতীত অন্যের উদ্দেশে ইবাদত করা শিরক। আর আমরা জানলাম যে, আশুরার প্রারম্ভ হযরত আদম (আ.) এর যুগ থেকে। সুতরাং চৌদ্দশত বছর পূর্বের হযরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদতের ঘটনা আশুরার মূল উপজীব্য নয়। তবে যেহেতু তিনি খিলাফাতের জন্য শহীদ হয়েছেন সেহেতু আমরা সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে রাসূলে আকরাম (সা.) এর প্রতিষ্ঠিত খেলাফতকে প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে যোগ দিতে পারি। কেউ কি পরীক্ষায় ফেল করলে- সেজন্য বছর বছর রোনাজারি করবে নাকি পুন:উদ্যোমে পরীক্ষা পাশের জন্য শিক্ষা গ্রহণ করবে? সুতরাং এই বুক চাপড়ানো, আত্বাহুতি দেওয়া, ধারালো ছুরিতে নিজেকে ক্ষতবিক্ষত করা হযরত হুসাইন (রা.) এর শাহাদৎকে এক প্রকার প্রহসন করার নামান্তর। উপর্যুক্ত বর্জনীয় কাজগুলি ছাড়াও ইসলামের মধ্যে নব্য সংযোজিত বিষয়সমূহ। যেমন- ঢোল-বাজনা, লাঠি খেলা এবং অন্যান্য প্রোগ্রামের মাধ্যমে মুহররম উদযাপন করা। তাজিয়া তৈরি করা এবং তাজিয়াকে সম্মান করা। কারবালার ঘটনাকে স্মরণ করে মর্সিয়া গাওয়া ইত্যাদি।
লেখক: কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক।