পেশাদার রংমিস্ত্রি বগুড়ার বাবলু মাছির খামার করে সম্ভাবনার নয়া পথ দেখাচ্ছেন
মশা-মাছি কথাটা এমনিতেই অতি তুচ্ছ বিষয়। মাছি থেকে যত দুরে থাকা যায়, ততই ভালো। এই ধারনাটার এখন আমুল পরিবর্তন হয়েছে। অতি নগণ্য আর তুচ্ছ মাছিকে এখন মানুষ আদর করে কাছে টেনে নিচ্ছেন। মাছি তাড়ানোর পরিবর্তে আদর করে লালন পালন করা হচ্ছে। নগণ্য মাছিকে যত্ন আত্তি করে খাবার দাবার দিয়ে খামারে লালন পালন করার এই ধারণাটা এখন সারা পৃথিবীতে খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
ঘৃণিত সেই মাছিই এখন সোনার মত দামি হয়ে উঠছে। আর সে কারনেই সারা পৃথিবীতে মাছির লালন পালন আর চাষাবাদ হুহু করে বাড়ছে। মাছির খামার দেখাচ্ছে অর্থনৈতিক বিপ্লবের নতুন দিগন্ত। উন্নয়ন অগ্রগতির সেই সম্ভানার পথে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশেও । বাংলাদেশে মাছির খামারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। মাছি বিপ্লবের পথ দেখাতে থেমে নেই উত্তরাঞ্চলের রাজধানী বগুড়াও। বগুড়ার স্বপ্নবাজ বাবলু মাছির খামারে সম্ভাবনার নতুন পথ দেখাচ্ছেন। খামারে চাষাবাদ করা মাছি থেকে তৈরি হচ্ছে হাঁস-মুরগী ও মাছের খাদ্য। তুচ্ছ মাছি থেকে তৈরি হওয়া উচ্চ মাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ এই মুল্যবান খাবার পোল্ট্রি শিল্পের ধারনাই পাল্টে দিচ্ছে।
বিনা খরচে মাছি পালন করে সেই মাছি থেকে মুল্যবান পোল্ট্রি ফিড ও ফিশ ফিড উৎপন্ন হওয়ায় অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উম্মোচিত হচ্ছে উদ্দোক্তাদের সামনে। যারা হাস-মুরগীর খামার করেছেন কিংবা মাছের খামার করেছেন, তারা সেই খামারের পাশেই যদি গড়ে তোলেন মাছির খামার,তাহলে ফিড কেনার জন্য তাকে আর পেরেশান হতে হবে না। এই মাছি থেকেই খামারের ৭০ ভাগ খাদ্যের চাহিদা মিটবে। পোল্ট্রি খামার ও মাছের খামারের এই প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব খাদ্য একদিকে যেমন স্বাস্থ্যকর অন্যদিকে তেমনিই নিরাপদ এবং অত্যন্ত ব্যায় সাশ্রয়ী। কৃত্রিম ও রাসায়নিক ফিডের পরিবর্তে মাছির খামারে উৎপাদিত এই ন্যাচারাল ও জীবন্ত ফিডের কারনে খামারের হাঁস-মুরগী ও মাছের প্রকৃত সুস্বাদও ফিরে আসছে।
মাছি চাষ করার ধারনাটা বাংলাদেশে তেমন একটা প্রচলিত নয়। তারপরও মাছির চাষাবাদ দ্রুত বিস্তৃত হচ্ছে সারাদেশে। বগুড়ার শেরপুরের স্বপ্নবাজ খামারী মেহেদী হাসান বাবলু গড়ে তুলেছেন মাছি লালন পালনের এক বিশাল সাম্রাজ্য। রাত দিন পড়ে আছেন মাছির খামারে। ‘মাছি মারা কেরানি কথাটা’ বলা হয় কর্মহীন অপদার্থ মানুষকে হেয় করার জন্য।বাংলা সাহিত্যেও দুধের মাছি নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। মাছি নিয়ে সেইসব গল্পের দিন শেষ। মাছিই এখন ব্যাপক সম্ভানাময়ী সম্পদ। কারণ, মাছি থেকেই তৈরি হচ্ছে উন্নত মানের পুষ্টি সমৃদ্ধ পোল্ট্রি ও ফিশ ফিড। বাংলাদেশে পোল্ট্রি এবং মাছ চাষে যে বিপ্লব ঘটেছে তা থমকে দাঁড়িয়েছে শুধুমাত্র ফিডের আকাশচুম্বী দামের কারনে।
অধিকাংশ ক্ষুদ্র উদ্যেক্তা ও খামারীদের লোকসান দিতে হচ্ছে ফিডমিল সিন্ডিকেটের কারনে। লাভের ভাগ চুষে খাচ্ছে ফিড কোম্পানীগুলো। এই অবস্থায় সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হচ্ছে মাছির খামারে। যে মাছি নিয়ে এতো কানামাছি খেলা, সেই মাছির নাম ব্লাক সোলজার ফ্লাই। সংক্ষেপে বিএসফ। এই প্রজাতির মাছি পালন করেই উৎপাদন করা হচ্ছে উ”চ মাত্রার প্রোটিন সমৃদ্ধ পোল্ট্রি ও ফিশ ফিড। মাছি লালন পালনে কোন খরচ নেই। পরিত্যাক্ত শাক সবজি,ফেলে দেওয়া ফলমুল আর বিনা মুল্যের খাদ্য খেয়েই মাছি উৎপাদন করছে মুল্যবান ফিড। আর সেই ফিড থেকে পোল্ট্রি খামারী কিংবা মাছ চাষীদের উৎপাদন খরচ ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কমে যাচ্ছে। মাছির খামারে উৎপন্ন লার্ভা থেকে তৈরী হচ্ছে হাঁস-মুরগী এবং মাছের উৎকৃষ্ট এবং নিরাপদ খাবার।
বাজারে প্রচলিত ক্ষতিকর ম্যালামাইন কিংবা ট্যানারি বর্জ্য মিশ্রিত পোল্ট্রি ও ফিশ ফিডে যে পরিমান প্রোটিন থাকে, তার থেকে দ্বিগুন প্রোটিন সমৃদ্ধ মাছির লার্ভা এখন পোল্ট্রি শিল্পের আশীর্বাদ হয়ে দেখা দিচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন,পোল্ট্রি খামারী কিংবা মাছ চাষীদের জন্য এই মাছিই হয়ে উঠবে আগামী দিনের সোনালী স্বপ্ন পুরনের হাতিয়ার। পোল্ট্রির বাজার পড়ে গেলেই খামারীকে লোকসান দিতে হবে,সেই দিন এখন আর নেই। কারণ উ”চমুল্যের ফিডের কারনে যে পরিমান উৎপাদন ব্যায় হচ্ছিল,তা থেকে যদি ৭০ ভাগ খরচ কমিয়ে মাছি দিয়ে পুরন করা যায়, তাহলে বাজার যতই ওঠা নামা করুক না কেনো,লাভের ভাগ ফিড মালিকরা চুষে খাওয়ার সুযোগ পাবেন না। এরফলে লাভবান হবেন পোল্ট্রি খামারী ও মাছ চাষীরা। কীভাবে শুরু হলো এই মাছির খামার ? বাংলাদেশেই বা কেনো দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে মাছি চাষের ধারণা ? বগুড়ায় এমন সাহসী উদ্যোগের পেছনে কাজ করছে কোন স্বপ্নবাজের সোনালী স্বপ্ন ?
সম্ভাবনাময় যে মাছির খামারের কথা উপরে তুলে ধরা হয়েছে, সেই ব্লাক সোলজার ফ্লাই বা বিএসফ মাছি মুলত একধরনের পোকা। সেই পোকা থেকেই শেষধাপে গিয়ে উড়ন্ত মাছির উৎপত্তি হয়। পরিনত বয়সের মাছির ডিম থেকে যে লার্ভা বেড়ে ওঠে, সেটা মুলত সচরাচর দেখতে পাওয়া এক ধরনের পোকা। মাছির সেই লার্ভা বা পোকাই হচ্ছে হাঁস-মুরগী ও মাছের মুল্যবান খাদ্য। শুনতে গা ঘিনঘিন করলেও সেই পোকাই এখন বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল করার স্বপ্ন দেখাচ্ছে। সেই পোকার খামারই এখন ভাগ্য বদলানোর পথ দেখাচ্ছে কোটি কোটি বেকারের।মাছির খামারে ভাগ্য বদলে যাবে, প্রথমে এমনটা বিশ্বাস হয়নি বাবলুর। তারপরেও নতুন কিছু করার প্রতি অদম্য আগ্রহ থেকেই মাছির খামার গড়ে তুলেছেন তিনি। শুরুতেই একেক জনের একেকরকম বাঁকা কথা আর প্রবল প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এখন সেই মাছির খামারেই ভাগ্য বদলানোর সম্ভাবনা দেখছেন বগুড়ার শেরপুরের রংতুলির শিল্পী মেহেদী হাসান বাবলু। বগুড়ার শেরপুর উপজেলার স্যান্নাল পাড়ার সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ আবুল কাশেমের ছেলে মেহেদী হাসান বাবলু ছিলেন পেশাদার রংমিস্ত্রি। পেইন্টিংই তার নেশা ও পেশা। রং আর তুলির আঁচড়ে ইটপাথরের দেওয়ালকে একরকম জীবন্ত করে তোলার দক্ষ শিল্পী তিনি। কিন্ত তাতে তার মন ভরেনি। সবসময় নতুন কিছু করার অদম্য বাসনাই তাকে বাধ্য করেছে মাছির খামার করার মত এক দু:সাহসী পদক্ষেপ নিতে।
পেইন্টিং পেশার পাশাপশি ২০২১ সালে বাবলু মেহেদী এগ্রো ফার্ম নামে মুরগীর খামার গড়ে তোলেন।এই উদ্দ্যোগ নেওয়ার পর তিনি দেখলেন যে, তার লাভের ভাগ ফিডে খাচ্ছে। লাভ লোকসন সব নির্ভর ফিড কোম্পানীর ওপর।তার ভাগ্য নির্ভর করছে ফিডের দাম ওঠা-নামার ওপরে। বাজারে পোল্ট্রি ও ফিশ ফিডের দাম বাড়লেই খামারীদের লোকসান দিতে হয়।ফিড কোম্পানীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়া বাংলাদেশের পোল্ট্রি ও ফিশারিজ শিল্পের এই দুরবস্থা নিয়ে দু:শ্চিন্তায় পড়েন বাবলু। নিজের খামারের খাদ্য নিয় দুশ্চিন্তা করতেই করতেই সোস্যাল মিডিয়ায় তার নজরে আসে ব্লাক সোলজার ফ্লাইয়ের খামারের কথা। সাথে সাথে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে, তার মুরগীর খামারের ফিডের জন্য মাছির খামার গড়ে তুলবেন।
একদিন সোস্যাল মিডিয়াতেই পেয়ে যান মাছির খামারী গাইবান্ধার মামুনের সন্ধান। সেখানে ছুটে যান তিনি। তারপর আর কোন পিছুটান নয়।মামুনের কাছ থেকে মা মাছি কিনে এনে শেরপুরের মির্জাপুর ইউনিয়নের তালতা গ্রামে গড়ে তোলেন মাছির খামার। শুরু হয় ভাগ্য বদলের নতুন অধ্যায়। বাংলাদেশে ব্লাক সোলজার ফ্লাই বা বিএসফ নামক মাছির খামারের শুরু হয়েছে মাত্র কয়েক মাস আগে। এ বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম এই মাছির খামার যাত্রা শুরু করেছে। গাইবান্ধার জূলফিকার আলী মামুন চীন থেকে ব্লাক সোলজার ফ্লাই মাছি এনে তার নিজ গ্রামের বাড়িতে খামার গড়ে তোলেন। শুরুতেই এটি তেমন কোন প্রচারের মুখ দেখেনি। তবে এই খাতে নিরবে বিপ্লব ঘটে গেছে ইতমধ্যেই।
এখন সারা দেশে প্রায় শতাধিক মাছির খামার গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশে এই মাছির খামার এখন এতোটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে যে, প্রতিদিনই নতুন নতুন উদ্যোক্তাদের মাছির খামার গড়ে তুলতে দেখা যাচ্ছে। এখন থেকে মাত্র ৭ মাস আগে গাইবান্ধার জুলফিকার আলী মামুন চীন থেকে মাত্র পাঁচ কেজি ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই কিনে এনে মাছির খামার শুরু করেছিলেন। সেই মাছির খামার থেকে এ পর্যন্ত দুই হাজার কেজিরও বেশি লার্ভা, মূল পোকা এবং জৈবসার তৈরি করেছেন তিনি। মামুনের সেই খামারের এক কেজি মা পোকার দাম দুই হাজার টাকা। মাছির লার্ভা ৭০ টাকা কেজি এবং খামারের বর্জ্য থেকে তৈরি জৈব সার ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নতুন নতুন উদ্যোক্তারা গাইবান্ধায় মামুনের খামারে ছুটে আসছেন। সেখান থেকে কিনে নিয়ে যাচ্ছেন মা মাছি। মাছির খামারের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এতোটাই নিশ্চিত যে বিশ্বের অনেক বড় বড় কোম্পানী এই খাতে বিনিয়োগ করা শুরু করেছে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, ২০৩০ সাল নাগাদ এই মাছি থেকে বৈশ্বিক বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৩৪ শতাংশেরও বেশি হবে।
প্রাণী সম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে বাংলাদেশে প্রায় ষাট হাজার মুরগীর খামার ও ৫ হাজারেরও বেশি হাঁসের খামার রয়েছে।এসব খামারে ফিডের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিনিয়ত বাড়ছে ফিডের দাম। বার বার ফিডের দাম বৃদ্ধির কারনে ছোট বড় সব ধরনের খামারিরাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন।এখন ফিড কোম্পানীর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে খামারীদের ভাগ্য। সেই অবস্থা থেকে খামারীদের উদ্ধারের পথ দেখাচ্ছে বিএসএফ।
এফ শাহজাহান, বগুড়া থেকে