একজন মোশাররফ হোসেন: সাদা মনের আলোকিত মানুষটিকে আল্লাহ জান্নাতবাসী করুন
এম আবদুল্লাহ
দেখতে দেখতে ৮ বছর হয়ে গেলো। আজকের দিনে (১৮ আগষ্ট) অগণিত সহকর্মী, ভক্ত, অনুরাগীকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান একজন মোশাররফ হোসেন। এক অর্থে তিনি ভাগ্যবান। মত্যুশয্যায় দীর্ঘ সময় কষ্ট করেননি, পরিবার পরিজনকেও কষ্ট দেননি। দুপুরে প্রাণোচ্ছল, বিকেলে অসুস্থ হয়ে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে। আর সূর্যাস্তের লগ্নে হৃদস্পন্দন থেমে অস্তমিত হয় অগণিত অসহায় দুঃখী মানুষের ভরসার সূর্য। এ ধরণের মৃত্যুকে সুন্দর মৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করা হয়। না ভূগে, কাউকে না ভূগিয়ে এমন মৃত্যু অনেকের কাম্য।
কিন্তু সমাজ সচেতন, জনদরদী, সাদা মনের আলোকিত মানুষটিকে হারিয়ে অনেকেই শোক সাগরে ভেসেছেন। সমাজের নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ যার ছায়া, স্নেহ, সান্নিধ্য পেয়েছেন তারা একজন মোশাররফ হোসেনের অভাব অনুভব করছেন পদে পদে। ঢাকা থেকে ফেনীর সোনাগাজী পর্যন্ত বহু মানুষ ঢুকরে ঢুকরে কেঁদেছেন।
মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ছিলেন একাধারে শিল্পপতি, রাজনীতিক, এবং দরাজ দিলের সমাজহিতৌষী। নিরহংকার, ধর্মপরায়ন, উদার, প্রাণখোলা, সদালাপী এই ব্যক্তিত্বের নেশা ছিল জনকল্যাণ। অতুলনীয় বিনয়, বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা আর দেশ ও মানুষের প্রতি সীমাহীন মমতা মোশাররফ হোসেনকে উন্নীত করেছিল জননন্দিত ব্যক্তিত্বে।
মোশাররফ হোসেনের কর্মজীবন শুরু সাংবাদিকতা পেশায়। ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন শাস্ত্রে পড়ার সময় তার সতীর্থ ও বন্ধু জাকি উদ্দিন আহমদসহ সাংবাদিকতা ও ব্যবসায় জড়ান। স্বাধীনচেতা মন তাকে মহান পেশা সাংবাদিকতার ভুবনে টেনে নেয়। পাকিস্তান আমল থেকে ৯০ এর দশক পর্যন্ত তিনি ‘দি কনসেপ্ট’, মাসিক ডাইজেস্ট, মাসিক কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি এবং মাসিক ফ্যাশন টেক্সটাইল এন্ড গার্মেন্টস নিউজ-এর প্রকাশনা ও সম্পাদনা করেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি ইংরেজী দৈনিক দি ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস পত্রিকার প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল পাবলিকেশন্স লি. এর পরিচালক ছিলেন। দৈনিক দিনকালের পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি আমৃত্যু পত্রিকাটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন। ফেরদৌস আহমদ কোরেশীর দৈনিক দেশ বাংলা পত্রিকাটিতেও তাঁর বিনিয়োগ ছিল। এছাড়া সাংবাদিকদের সুখে-দু:খে পাশে থাকতেন অকৃপনভাবে।
আমার দেখা মতে মোশাররফ হোসেনের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় সাংবাদিকতা পেশায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এমন অন্তত চার জন বর্তমানে প্রথম সারির জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন। জাতীয় প্রেস ক্লাব, বিএফইউজে, ডিইউজেসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের প্রকাশনা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনে সহযোগিতা চেয়ে কখনো বিমুখ হয়নি। সমাজসেবা, বই পড়া ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা দেখা তার প্রধান শখ ছিল।
বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে ছোট্ট পরিসরে বিজ্ঞাপনী সংস্থার মাধ্যমে যার ব্যবসা শুরু, তিনি পরবর্তিতে পোশাক শিল্প, রিয়েল এ্যাষ্টেট, প্রকাশনা, ব্যাংকিং, জনশক্তিসহ বিভিন্ন ব্যবসা পরিচালনা করে উদ্যোক্তা হিসেবে ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করেন। বাংলাদেশের মূল্যবান বৈদেশিক মূদ্রা আয়ের প্রধান দু’টি খাত জনশক্তি রফতানি ও গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশে তাঁর অবদান স্বর্ণোজ্জ্বল। তিনবার বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফেকচারার্স এন্ড এক্সপোর্টাস এসোসিয়েশন (বিজিএমইএ)-এর সভাপতি থাকাকালে তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশে গার্মেন্টস খাতে বৈদেশিক মূদ্রার আয় কয়েকশ’ কোটি টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে কয়েক হাজার কোটিতে দাঁড়ায়। এটা সম্ভব হয়েছে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নিষ্ঠার কারণে। গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ শাসনামলে বাটেক্সপো উপলক্ষে বিজিএমইএ’র পক্ষ থেকে তাঁকে সম্মানসূচক পদকে ভূষিত করা হয়। বিজিএমইএতে নেতৃত্ব নির্বাচনে বর্তমানে যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তার প্রবর্তক মরহুম মোশাররফ হোসেন। তার আগে মনোনীত ব্যক্তিরাই বিজিএমইতে নেতৃত্ব দিতেন। তিনি উদ্যোগী হয়ে নির্বাচনী ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।
একইভাবে পরবর্তীকালে তিনি দেশের সর্বাধিক বৈদেশিক মূদ্রা অর্জনকারী জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রটিং এজেন্সীজ (বায়রা) এর কয়েক মেয়াদে সভাপতি থাকাকালে বিশ্বব্যাপী শ্রমবাজারের প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বায়রাতেও তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নেতৃত্ব নির্বাচনের ধারা প্রবর্তন করেন। বিজিএমইএ ও বায়রার নেতৃত্ব থেকে নিজে সরে আসার আগ পর্যন্ত কেউ তার বিকল্প ভাবতে পারেনি। বাংলাদেশের জনশক্তি রফতানিতে পাইওনীয়ার রিক্রুটিং এজেন্সী বে-ইস্টার্ণ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন তার বন্ধু জাকি উদ্দিন আহমদের সাথে যৌথভাবে ব্যবসা পরিচালনা করে বন্ধুত্বের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
ব্যবসা পরিচালনা করে সম্পদের পাহাড় গড়ার নেশা কখনোই পেয়ে বসেনি তাঁকে । বরাবরই তাঁর নেশা ছিল সমাজসেবা ও জনকল্যাণ। রাজধানী ও নিজ এলাকা সোনাগাজীতে বহু সংখ্যক স্কুল, মাদ্রাসা, মসজিদ, এতিমখানা, পাঠাগার নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠা ও পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন নিয়মিত। এছাড়া বেকারত্ব নিরসনে বেকার যুবকদের দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছিল তাঁর ব্রত। গরীব-দুঃখী অসহায় বহু পরিবার তার সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ছিল।
ইসলামী ব্যংক বাংলাদেশের অন্যতম উদ্যোক্তা মোশাররফ হোসেন জন্মগতভাবেই ইসলামী মূল্যবোধ ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। তিনি ১৯৮৩ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক ছিলেন। আমৃত্যু তিনি ব্যাংকটির অন্যতম স্পন্সর ছিলেন। ১৯৮৪ সাল থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত মোশাররফ হোসেন ব্যাংকের কমার্শিয়াল অপারেশন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন দক্ষতার সাথে। ২০০০ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের নির্বাহী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সক্রিয় রাজনীতিকে যুক্ত হওয়ায় স্বেচ্ছায় তিনি ব্যাংকের বিভিন্ন দায়িত্ব থেকে সরে আসেন।
মোশাররফ হোসেনের কর্মময় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচিত হতো। ১৯৯৬ সালের আগে তিনি কখনোই সক্রিয় রাজনীতি করেননি। ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বচনের পূর্বে সোনাগাজীর জাতীয়তাবাদী জনগণ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হবার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করার পরও তিনি সম্মত হননি। বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া নিজে ১৯৯১ সালে তাকে মনোনয়ন দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিনয়ের সঙ্গে অপারগতা জানিয়ে নেপথ্যে কাজ করার কথা বলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে পারেননি। ১৯৯৬ সালের গোড়ার দিকে বিএনপির সরকার যখন আন্দোলনের মুখে ঠিক তখনই বিএনপি চেয়ারপর্সন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ডাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠেন। তিনি ‘৯৬’র ১৫ ফেব্র“য়ারীর নির্বাচনে ফেনী-১ আসনের জন্য বেগম জিয়ার নির্বাচন সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বেগম জিয়ার অনুরোধে। সে থেকেই মূলতঃ সক্রিয় রাজনীতির মাঠে মোশাররফ হোসেনের পদচারনা। বেগম জিয়া তাকে ফেনীর দায়িত্ব নেয়ার অনুরোধ জানালে তা তিনি প্রত্যাখ্যান করতে পারেননি।
১২ জুন ‘৯৬ এর নির্বাচনে ফেনী-৩ (ফেনী-সোনাগাজী) আসনে বিএনপির প্রার্থী হয়ে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জয়নাল হাজারীকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যা ছিল ৫৮ হাজার ৪শ’ ৩৯। প্রতিদ্বন্দ্বী জয়নাল হাজারী পেয়েছিলেন ৪২ হাজার ১শ’ ৮২ ভোট। এর পর তিনি ফেনী জেলা বিএনপির আহবায়ক ও পরে সভাপতি নির্বাচিতর দায়িত্ব পালন কলেন দীর্ঘদিন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় যায় আওয়ামী লীগ। সপ্তম সংসদে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কিমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। প্রথম বারের মত সংসদ সদস্য হয়ে মোশাররফ হোসেনকে পড়তে চরম রাজনৈতিক নিপীড়ন ও বৈরী পরিস্থিতির মুখে। সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসার পাশাপাশি তার কাছে পরাজিত এবং ফেনী-২ আসন থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারির ভয়ংকর মুর্তির মুখোমুখি হন। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত ৫টি বছর জনাব মোশাররফ হোসেনের নির্বাচনী এলাকা তথা গোটা ফেনীতে চলেছে আওয়ামী উন্মত্ত সন্ত্রাস ও বর্বরতা। ‘৯৬ সালের ২৩ জুনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে ২০০১ সালের ১৫ জুলাই ক্ষমতা হস্তান্তর পর্যন্ত ফেনী-সোনাগাজীর মানুষের জীবন ছিল বিপন্ন। কেউ শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি। এমনি দুর্যোগময় সময়ে মোশাররফ হোসেন এমপি সর্বদা তার এলাকার নির্যাতিত মানুষের পাশে ছিলেন। হাজারির স্টীয়ারিং বাহিনী তথা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত, আহত ও নির্যাতিতদের পাশে দাড়িয়েছেন, ছুটে গেছেন তাদের পরিবারের কাছে। সাধ্যমত আর্থিক সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।
২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ফেনী-৩ আসন থেকে ৯৪ হাজার ৩২১ ভোট পেয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মত সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। মোট প্রদত্ত ভোটের ৬৮ দশমিক ৩৫ শতাংশ পেয়েছিলেন মোশাররফ হোসেন। এবার দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নিজ দল বিএনপি ক্ষমতায় গেলেও মন্ত্রিত্বের পেছনে ছুটেননি এই নির্লোভ মানুষটি। দেশ ও জনগণের জন্য কাজ করেছেন তিনি। এলাকার উন্নয়নে নিরলসভাবে পরিশ্রম করেছেন। জনদরদী নেতাকে হারিয়ে ফেনী-সোনাগাজীর মানুষ অভিভাবকহীন হয়ে গেছে।
মরহুম মোশাররফ হোসেনের রূহের মাগফিরাত কামনা করছি। শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
বি: দ্র: লেখাটি সাংবাদিক নেতা এম আবদুল্লাহর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহিত।