২৭ আগষ্ট জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ইন্তেকাল বার্ষিকী: জ্যৈষ্ঠে এসেছিলেন তিনি- বিদায় নিয়েছিলেন ভাদ্রে

জ্যৈষ্ঠে এসেছিলেন তিনি। ভাদ্রে বিদায় নিয়েছেন। শোষিত-নিপীড়িত মানুষের বঞ্চনার ক্ষোভ দীপ্ত শিখার মতো জ্বলে উঠেছিল তার কণ্ঠে। সাম্প্রদায়িকতার বিষকে দূর করে তুলে এনেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষ মানবতার অমৃত বাণী। আবার তিনিই কোমল সুকুমার হূদয়ানুভবে আবেগে থরথর। তিনি বিদ্রোহী, তিনিই গানের পাখি বুলবুল। জাতীয় কবি হিসেবে পরিচিতি তার, তিনি কাজী নজরুল ইসলাম। আজ ১২ ভাদ্র। তার ৪৬তম ইন্তেকাল বার্ষিকী

১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ অবিভক্ত বাংলার বর্ধমান জেলার চুরুলিয়ায় যে কবির আবির্ভাব ঘটেছিল ‘জ্যৈষ্ঠের ঝড়’ হয়ে, সে ঝড় চিরতরে থেমে গিয়েছিল ঢাকার পিজি হাসপাতালের (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) কেবিনে, ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ ভাদ্রে। অঙ্কের হিসাবে তার জীবনকাল ৭৭ বছরের; তবে সৃষ্টিশীল ছিলেন মাত্র ২৩ বছর। নজরুলের এই ২৩ বছরের সাহিত্যজীবনের সৃষ্টিকর্ম বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। যে কারণে জাতি আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় স্মরণ করবে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে। সারাদেশে কবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে দিনটি পালিত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত কবির সমাধি ছেয়ে যাবে বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবাসার ফুলে ফুলে। যেমনটি প্রতিবার হয়।

তার লেখনিতে দ্রোহ, প্রেম, সাম্য, মানবতা ও শোষিত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির বার্তা প্রকাশ পেয়েছে প্রবলভাবে। এ কারণে তিনি বিদ্রোহী। তার প্রেমিক রূপটিও প্রবাদপ্রতিম। তাইতো তিনি কবিতার ছত্রে ছত্রে বলেছেন, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আয়নায়।’ পৃথিবীতে এমন ক’জন আছেন যিনি প্রেমের টানে রক্তের সম্পর্ক অস্বীকার করে পথে বেরিয়ে পড়তে পারেন। তিনি হলেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস। নজরুলের সাহিত্যকর্মের মধ্যে উল্লেখযোগ্য তার গান। তার লেখা নজরুলগীতি, যা নজরুলসংগীত বলে পরিচিত। শত শত জনপ্রিয় গানের রচয়িতা ও সুরস্রষ্টা তিনি। তার রচিত ‘চল্ চল্ চল্!/ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল’ বাংলাদেশের রণসংগীত। বাংলা সাহিত্যে তার অবদান অসামান্য। অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী ও সাম্যের এই কবি আছেন কোটি কোটি বাঙালির হূদয়ে। জীবদ্দশায় তিনি সর্বদা হিন্দু-মুসলমান মিলনের গান গেয়েছেন। বিদ্রোহী কবির মর্যাদা পেলেও তিনি ছিলেন মূলত প্রেমের কবি।

কাজী নজরুল ইসলামই এ দেশের সমাজচেতনা ও রাজনৈতিক জগতের সর্বোত্তম কবি, যিনি গণমানুষের সঙ্গে সাহিত্যের যোগসূত্র স্থাপন করেছেন। নজরুলের আবির্ভাবে যেন বাংলা সাহিত্যের একটা নতুন দিক খুলে গেল। তিনি ছিলেন কর্মে ও চিন্তায় স্বাধীন; দাসত্বের বন্ধনমুক্তি ও প্রাচীন সংস্কারের শৃঙ্খল ভঙ্গ করার সংগ্রামে উচ্চকণ্ঠ। তার সৃজনশীল কর্মে এসব প্রকাশ পেয়েছে পরতে পরতে। তার কাব্যের বাণী, গানের কথা কিংবা ক্ষুরধার লেখনী বুলেটের চেয়ে শক্তিশালী ছিল। বাংলা সাহিত্যে নজরুল এসেছেন অন্যায়-অসাম্যের বিরুদ্ধে চরম বিদ্রোহ নিয়ে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলন পর্যন্ত বিপুল প্রেরণা জুগিয়েছে তার গান, রচনাবলি ও কবিতা। রবীন্দ্রনাথের অনুকরণমুক্ত কবিতা রচনায় তার অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যতিক্রমধর্মী কবিতার জন্যই ‘ত্রিশোত্তর আধুনিক কবিতা’র সৃষ্টি সহজতর হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

নজরুল তার সাহিত্যকর্ম এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে অবিভক্ত বাংলায় পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ এবং দেশি-বিদেশি শোষণের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। এ কারণে ইংরেজ সরকার তার বেশ কয়েকটি গ্রন্থ ও পত্রিকা নিষিদ্ধ করে। কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তারপরও তিনি দমে যাননি। বরং উৎসাহ পেয়েছেন। রাজবন্দীর জবানবন্দী এবং প্রায় ৪০ দিন একটানা অনশন করে ইংরেজ সরকারের জেল-জুলুমের প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। এজন্য তাকে গ্রন্থ উৎসর্গ করে শ্রদ্ধা জানান নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

জন্মস্থান ভারতের বর্ধমান হলেও বাংলাদেশের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তার। কৈশোরের একটা পর্যায় কেটেছে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুরে। কুমিল্লায় কবির শ্বশুরবাড়ি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে কেটেছে তার আনন্দ-বেদনার অনেক দিন। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার কাছে সমান প্রিয় তিনি। অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে তিনি লিখে গেছেন অবিরাম। বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে তার অজস্র কবিতা, বাংলা গানের জগৎকে গীত-সুধারসে ভরিয়ে দিয়েছে তার গানের কলি, তাতে যোগ করেছে নতুন মাত্রা ও স্বাদ। গান ও কবিতার মাধ্যমে তিনি অবহেলিত-বঞ্চিত মানুষের পাশে যেমন দাঁড়িয়েছেন, তেমনি বিরল শিল্প সুষমায় ভরিয়ে তুলেছেন বাঙালির সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারকে। প্রজন্মপরম্পরায় এই কবির জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা এখনো আকাশচুম্বী।

দারিদ্র্যের কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও তিনি কখনো আপস করেননি। মাথা নত করেননি লোভ-লালসা, খ্যাতি, অর্থ-বিত্ত ও বৈভবের কাছে। ‘চির উন্নত মম শির’ বলে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কলকাতায় নজরুল ও প্রমীলার বিবাহ সম্পন্ন হয়। প্রমীলা ছিলেন ব্রাহ্মসমাজভুক্ত। তার মা গিরিবালা দেবী ছাড়া পরিবারের অন্যরা এ বিবাহ সমর্থন করেননি। নজরুলও আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। হুগলির মহীয়সী নারী মাসুমা রহমান বিবাহপর্বে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। নজরুল হুগলিতে সংসার পাতেন। বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। বৈচিত্র্যময় অসংখ্য রাগ-রাগিনী সৃষ্টি করে বাংলা সংগীত জগৎকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন। কবিতার পাশাপাশি বাংলা গানের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলা গজলের প্রবর্তক বলা হয় তাকে। তিনিই প্রথম বাংলা গজল রচনা করেন।

শৈশবে পিতৃহারা হন নজরুল। তারপর বহু বাধার প্রাচীর পাড়ি দিতে হয়েছিল তাকে। অতঃপর এক দিন মহাযুদ্ধের ডাক। যোগ দিলেন বাঙালি পল্টনে। যুদ্ধ থেকে ফিরলেন হাবিলদার কবি। সবাইকে চমকে দিয়ে বাংলার সাহিত্য আকাশে দোর্দণ্ড প্রতাপে আত্মপ্রকাশ। কবিরূপে নজরুলের এ অভ্যুদয় ধূমকেতুর সঙ্গেই তুলনীয় কেবল। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে ‘বসন্ত’ নাটক উৎসর্গ করতে গিয়ে যথার্থ লিখেছেন— ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয় রে ধূমকেতু/আঁধারে বাঁধ। অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।’

বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। ব্রিটিশরাজের আসন টলে উঠেছে তার দ্রোহী কবিতায়। ১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। প্রথম গদ্য রচনা বাউণ্ডুলের অত্মকাহিনী ১৯১৯ সালের মে মাসে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৯২২ সালে নজরুলের একটি গল্প সংকলন প্রকাশিত হয়, যার নাম ‘ব্যথার দান’। একই বছর প্রবন্ধ-সংকলন ‘যুগবাণী’ও প্রকাশিত হয়। নজরুলের প্রেম ও প্রকৃতির কবিতার প্রথম সংকলন দোলন-চাঁপা প্রকাশিত হয় ১৯২৩ সালের অক্টোবরে। এতে সংকলিত দীর্ঘ কবিতা ‘পূজারিণী’-তে নজরুলের রোমান্টিক প্রেম-চেতনার বহুমাত্রিক স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে। কবি নজরুল ধ্যানে-জ্ঞানে, নিঃশ্বাসে-বিশ্বাসে, চিন্তাচেতনায় ছিলেন পুরোদস্তুর অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী। কবিতায়, গানে, গদ্যে সর্বত্র তার এই উদার দৃষ্টিভঙ্গি উৎকীর্ণ। শোষিত বঞ্চিত মানুষকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন সাম্য ও ন্যায়ের বন্ধনে এক হয়ে শোষণ, বঞ্চনা ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হতে। তাই কবি গেয়েছেন, ‘গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান’।

স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনেন। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক বিশেষ সমাবর্তনে কবিকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে নজরুলকে বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান এবং ২১ ফেব্রুয়ারি ‘একুশে পদকে’ ভূষিত করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের উত্তর পার্শ্বে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে।

কৃতজ্ঞতা: দৈনিক নয়া শতাব্দী

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *