মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন সাড়ে চারশ বছর ধরে নিয়মিত নামাজ আদায় বগুড়ার এই মসজিদে
বগুড়া অফিস:
বগুড়ায় ভোর থেকেই কয়েক দফা বৃষ্টি পড়েছে। বৃষ্টির মাঝেই অদেখাকে দেখার কৌতূহল নিয়ে শহরের সাতমাথা থেকে যাত্রা করেছিলাম শেরপুরের উদ্দেশ্যে। বৃষ্টির কারণে যাত্রী কিছুটা কম থাকায় কয়েকটি ফাঁকা সিট নিয়েই রওনা হয় করতোয়া গেটলক বাসটি। ৪০ মিনিটের মতো সময় লাগে বগুড়া থেকে ধুনট মোড় আসতে। এরপর ধুনট মোড় থেকে অটোরিকশায় করে চলতে থাকলাম শাহবন্দেগী ইউনিয়নের খন্দকার টোলা গ্রামে।
লোকমুখে শুনেছিলাম এদিকের রাস্তার অবস্থা একটু খারাপ হবে। কিন্তু ধারণার চেয়েও বেশ ভোগান্তি পোহাতে হলো। গ্রামটির অধিকাংশ রাস্তায় বেশ পানি জমে আছে।
খেরুয়া মসজিদ বাংলাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন। মুঘল-পূর্ব সুলতানি আমলের স্থাপত্যশৈলীর সঙ্গে মোগল স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে নির্মিত এই মসজিদ। এর নির্মাণশৈলীর সঙ্গে বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের বেশ মিল রয়েছে।
প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ল একটি পুরোনো কবর। এখানে শায়িত আছেন আবদুস সামাদ নামের এক ব্যক্তি। এখানকার তত্ত্বাবধায়কের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এই কবরের সীমানা প্রাচীরটি তৈরি করা হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। তবে আগের দিনে কবরটি বোঝার জন্য শুধু কয়েকটি পাথর খ- রাখা হয়েছিলো।
প্রায় ৪৫০ বছর ধরে টিকে আছে এই মসজিদ। বাহিরে থেকে দেখা যায় এই মসজিদটির উপরে তিনটি গম্বুজ রয়েছে এবং চারপাশে চারটি টাওয়ার রয়েছে। মসজিদটির গাঁথুনিতে ব্যবহার করা হয়েছে চুন-সুরকি যা কাঠামোকে দৃঢ়তা প্রদান করেছে। মসজিদটির পাঁচটি প্রবেশপথ রয়েছে। মসজিদটির বাহিরে খুব নিখুঁতভাবে কিছু নকশা তৈরি করা হয়েছে এবং এর মাঝখানে একটি শিলালিপি রয়েছে।
মসজিদের সামনের দেয়ালে উৎকীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা যায়, ১৫৮২ সালে জওহর আলী কাকশালের পুত্র মির্জা মুরাদ খান কাকশাল এটি নির্মাণ করেছিলেন। ‘কাকশাল’ উপাধি ছিল তুর্কিদের দেয়া। ঘোড়াঘাট অঞ্চল ছিল তুর্কি জায়গীরদারদের অধীন। মির্জা মুরাদ খান কাকশালের বিশদ পরিচয় পাওয়া যায় না। শেরপুর সে সময় ঘোড়াঘাটের অধীনে একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। ঐতিহাসিকদের অনুমান মির্জা মুরাদ খান কাকশাল শেরপুরের জায়গিরদার বা ফৌজদার ছিলেন।
খেরুয়া মসজিদের নামকরণ স্পষ্ট নয়। তবে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার বাংলাদেশের প্রতœসম্পদ বইতে উল্লেখ করেছেন- এ মসজিদের খেরুয়া নামের কোনো ইতিবৃত্ত পাওয়া যায়নি। আরবি বা ফার্সি ভাষায় খেরুয়া বলে কোনো শব্দ পাওয়া যায় না। তবে ফার্সিতে ‘খায়ের গাহ্’ বলে শব্দ আছে। যার অর্থ ‘কোনো স্থানের ভেতরে’। রাজা মানসিংহ যখন বাংলার সুবাদার, তখন তিনি শেরপুরে একটি দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। এই দুর্গের কোনো অস্তিত্ব এখন নেই। তবে মসজিদটি যদি শেরপুর দুর্গের ভেতরে নির্মিত হয়ে থাকে, তবে ‘খায়ের গাহ্’ থেকে খেরুয়া নাম হতে পারে বলে অনুমান করা যায়।
মসজিদটির ইতিহাস নিয়ে একটি বইও আছে। যার নাম ‘শেরপুরের ইতিহাস (অতীত ও বর্তমান)’। বইটির লেখক অধ্যক্ষ মুহম্মদ রোস্তম আলী। বইটিতে লেখা তথ্যমতে, তখন ১৬ শতকের শেষ দিক। সময়টা ছিল বারোভুঁইয়া ও মোগলবিরোধী বিপ্লবের সংকটকালীন মুহূর্ত। কাকশাল বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি ছিল শেরপুর মোর্চা। বারোভুঁইয়া ছাড়াও আফগান বিদ্রোহীদের নেতা মাসুম খান কাবুলির সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে কাকশাল বিদ্রোহীরা। সেই সময় এই মসজিদ নির্মাণ করা হয়।
মসজিদের সামনের অংশে ২টি শিলালিপির ভেতরে ছিল স্বর্ণখ-, যা পরবর্তী সময়ে চুরি হয়ে যায়। এই মসজিদের দু‘টি শিলালিপির একটি বর্তমানে পাকিস্তানের করাচি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে বলে জানা যায়।
স্থানীয়রা জানান, এই মসজিদটিতে প্রথম দিকে কোন দরজা ছিল না পরবর্তীতে এখানে দরজা গুলো লাগানো হয়েছে এবং মসজিদটি সংস্কার করা হয়েছে। এই পাঁচটি দরজার মধ্যে একটি দরজা মসজিদের ভিতরে প্রবেশ করার জন্য খোলা রাখা হয়েছে। প্রাচীন এই মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় হয়। জুম্মার দিনে লোকজন কিছুটা বেশি হয়। এ কারণে মসজিদটির বাহিরে যদি অস্থায়ীভাবে নামাজের জায়গা করে দেওয়া হয় তাহলে সবার পক্ষে জুম্মার সালাত আদায় করা সম্ভব হবে।
আরও জানান, প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটির সীমানা প্রাচীর তৈরি করে দেওয়ায় মসজিদের পরিবেশটি ভালো আছে। শেরপুর থেকে মসজিদ পর্যন্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং রাস্তা ভালো না থাকার কারণে এখানে দর্শনার্থীদের আসতে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন হলে অর্থনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বগুড়ার খেরুয়া মসজিদ।
প্রত্নতত্ত অধিদপ্তর রাজশাহী ও রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়ের বগুড়ার আঞ্চলিক পরিচালক ড. নাহিদ সুলতানা বলেন, খেরুয়া মসজিদের সংস্কার কাজ করা হবে। এই প্রক্রিয়া চলমান আছে। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে মসজিদে আসার সড়কটিও সংস্কারে উদ্যোগ নেওয়া হবে